বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম
সুব্হা-নাল্লাযী-আস্রা বিআব্দিহী লাইলাম মিনাল মাস্জি¦দিল হারা-মি ইলাল্ মাস্জ্বিদিল আক্বছ¦াল্লাযী বা-রাকনা-হাওলাহূ লিনুরিয়াহূ মিন আ-যা-তিনা; ইন্নাহূ হূওয়াস সামীউল বাছ¦ীর। (সূরা বনী ইসরাঈল পারা ১৫, আয়াত ১)।
অর্থঃ সমস্ত দূর্বলতা, অক্ষমতা থেকে মুক্ত সেই মহিমাময় তিনি (আল্লাহ্) যিনি তাঁর বান্দা (মুহাম্মদ (সা.) কে) তাঁর নিদর্শন দেখাতে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম (কাবা শরীফ) হতে মসজিদুল আকসায় (ফিলিস্তিনের জেরুযালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা) যার পরিবেশ তিনি করেছিলেন বরকতময়; নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
মেরাজের ঘটনা বয়ান করতে গিয়ে নবীজী (সা.) বলেন, ‘আমার কাছে দুজন ফেরেশতা আসলেন, আমি উম্মেহানির ঘরে ঘুমন্ত ছিলাম। তারা আমাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে বাইতুল্লাহর কাছে হাতীমের ভিতরে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে যমযম কুয়ার কাছে আমাকে নেয়া হল। সেখানে আমার সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণ করা হল। আমার সীনা ফেড়ে তার মধ্য থেকে কলব বা হার্টটাকে বের করা হল। কলব ফেড়ে তা থেকে কি একটা বস্তু বের করা হল। তারপর যমযমের পানি দিয়ে কলবটাকে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হল’। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ মুখে বলতে ছিলেন, ‘দুজন ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিলেন। তারা আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে যান। সেখান থেকে সপ্তম আসমানের উপর পর্যন্ত আমি পৌঁছি। আল্লাহর দরবার পর্যন্ত পৌঁছি। আল্লাহর সাথে কথা হয়েছে। আল্লাহপাক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন’। (কুরআন-হাদীসের আলোকে শবে মেরাজ এবং মেরাজের ঘটনা-মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও তাবলীগের সাফল্য তখন অত্যাচার নির্যাতনের মাঝামাঝি পর্যায় অতিক্রম করে চলছিল, আর দূর দিগন্তে মিটিমিটি তারার আলো দেখা যাচ্ছিলো। এ সময় মেরাজের ঘটনা ঘটে। এ মেরাজ কবে সংঘটিত হয়েছিলো এ সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতভিন্নতা রয়েছে। যেমন-
এক. তাবারী বলেন, যে বছর নবী সাইযেদুল মোরসালীনকে নবুয়ত দেয়া হয়, সেই বছরই মেরাজ সংঘটিত হয়।
দুই. নবুয়ত লাভের পাঁচ বছর পর মেরাজ সংঘটিত হয়েছে। ইমাম নববী, ইমাম কুরতুবী এ অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
তিন. নবুয়তের দশম বর্ষের ২৭ শে রজব তারিখে মেরাজ সংঘটিত হয়েছে। আল্লামা মনসুপুরী এ অভিমত গ্রহণ করেছেন।
চার. হিজরতের ১৬ মাস আগে, নবুয়তের দ্বাদশ বছর রমযান মাসে মেরাজ অনুষ্ঠিত হয়।
পাঁচ. হিজরতের এক বছর দুই মাস আগে, নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের মহররম মাসে সংঘটিত হয়।
ছয়. হিজরতের এক বছর আগে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে হয়েছে।
উল্লিখিত বক্তব্যসমূহের মধ্যে তিনটি সঠিক বলে মেনে নেয়া হয়। কেননা, পাঞ্জেগানা নামায ফরয হওয়ার আগেই হযরত খাদিজা (রা.) এর ইন্তেকাল করেছিলেন। আর এ ব্যাপারে সবাই একমত পাঞ্জেগানা নামায মেরাজের রাতে ফরয হয়েছে। সেই হিসেবে মা খাদিজার মৃত্যু নবুয়তের দশম বর্ষের রমযান মাসে হয়েছে। কাজেই মেরাজের ঘটনা এর পরেই ঘটেছে, আগে নয়। শেষোক্ত তিনটি বক্তব্যের কোনোটিকে প্রাধান্য দেয়ার মতো, দলিল প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অবশ্য সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল) এর পূর্বাপর আলোচনা থেকে অনুমিত হয়, মেরাজের ঘটনা মক্কী জীবনের একেবারে শেষ দিকে সংঘটিত হয়।
আল্লামা মনসুপুরী অভিমত হিসেবে নবুয়তের দশম বর্ষের ২৭ শে রজব তারিখে মেরাজ সংঘটিত হয় বলে যে রেওয়াজ আছে সেটাকেই বর্তমানে আমাদের দেশে প্রাধান্য দেয়া হয়।
সে যাই হোক। বিশ্বনবী (সা.) জীবনে মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল এটা ১০০% সত্য ঘটনা এতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ করার অবকাশ নাই কোরআন ও হাদীসের আলোকে। আর কোরআনে পরিচয় কোরআন নিজেই করিয়ে দিচ্ছেন এভাবেই সুরা বাকারার প্রথম আয়াতেই। ‘আলিফ, লাম, মীম। জা-লিকাল কিতাবু লা-রাইবা-ফি’। অর্থ-‘(তিনটি অক্ষরের অর্থ আল্লাহপাকই ভালো জানেন) ইহা সেই কিতাব যাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।’
অনেক রেওয়াতে আছে নবীজী (সা.) এর জীবনে হজরত জিব্রাঈল (আ.) প্রায় ২৪ হাজার বার তাঁর কাছে আগমন করেন।এর মধ্যে মাত্র ২ (দুই) বার হজরত জিব্রাঈল (আ.) নিজ চেহারায় নবীজী (সা.) এর কাছে আগমন করেছিলেন।
হজুর (সা.) ততোক্ষণ কথা বলে নি যতক্ষণ হজরত জিব্রাঈল (আ.) কিছু না বলেছেন। হজরত জিব্রাঈল আমিন ফেরেশতা ততোক্ষণ কথা বলেন নি যতক্ষণ মহান আল্লাহপাক তাঁকে কিছু না বলেছেন। অতএব আমার আপনার নবী, বিশ্বনবী (সা.) মহান আল্লাহপাকের নির্দেশ ছাড়া একটি কথাও উচ্চারণ করে নি।
সুতরাং বিশ্বনবী (সা.) এর নিজ মুখে মেরাজের ঘটনা বয়ান করার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহপাকের কথাগুলোই তিনি বর্ণনা করতে ছিলেন। তাঁর ব্যক্ত করা ঘটনাকে কোনো মুসলমান অস্বীকার করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
বোরাকের বর্ণনা
যে বাহনে করে হুজুর (সা.) কে মেরাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার নাম বোরাক। হাদীস শরীফে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘এটা একটা সাদা রংয়ের জানোয়ার, যা গাঁধার চেয়ে একটু বড়, খচ্চরের চেয়ে একটু ছোট। তার গতি হল দৃষ্টির শেষ সীমা যতদূর যায় ততোদূরে এক এক কদম রাখে’। মানুষের দৃষ্টিসীমা কতদূর যায় তা কী কেউ বলতে পারে? পারে না। মানুষের একটা মন আছে এটা সবাই জানেন। কিন্তু সেই মনের সাক্ষাত কী কেউ পেয়েছেন? মনের একটা গতি আছে তা সবাই অনুভব করেন। তা না হলে নিমিষেই কীভাবে মন পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল? এই মনের গতিবেগ কত তা আমরা জানি না। যে আল্লাহপাক আমাদের মনকে সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহপাকই বিশ্বনবী (সা.) কে বোরাকে করে উর্ধ্বলোকে ভ্রমণ করিয়েছেন যা সূরা বনী ইসরাঈলের প্রথম আয়াতের শেষের দিকে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, ‘যার পরিবেশ তিনি করেছিলেন বরকতময়; নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’।
সুতরাং কাল্পনিক ভাবে আঁকা বোরাকের ছবি ঘরে রেখে ঈমানকে নষ্ট করবেন না। কারণ বোরাক রঙ তুলি দিয়ে আঁকার মত কোনো বাহন নয়।
‘মেরাজ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘সিঁড়ি’। বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে আসমানের দিকে আরোহণের সময় একটা চলন্ত সিঁড়ি আসে। বিশ্বনবী (সা.) হজরত জিব্রাইলে (আ.) সাথে বোরাকসহ সেই চলন্ত সিঁড়িতে করে উর্ধ্ব জগতে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, ‘সঠিক বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, নবী সাইয়েদুল মোরসালীন (সা.) কে সশরীরে বোরাকে তুলে হজরত জিব্রাঈল (আ.) এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মাকদেস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। তিনি এখানে অবতরণ করেন আর মাসজিদের দরজার কড়ার সাথে বোরাক বেঁধে রাখেন এবং সকল নবীব ইমাম হয়ে দুরাকাত নামায পড়ান’।
এখানে উল্লেখ্য, সেদিন বাইতুল মাকদাসে আল্লাহপাক পৃথিবীতে যত নবী রাসূল প্রেরণ করেছিলেন তাদের সমস্ত রূহ সশরীরে সেদিন ঐ মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। হজুর (সা.) এর ইমামতি করার মাধ্যমেও নবী-রাসূলগণের মধ্যেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। তিনি যে দুরাকাত নামায পড়িয়েছিলন তা পাঞ্জেগানা নামায নয়। সেটা ছিল হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর তরীকা মোতাবেক নামায।
মেরাজে গমণের সময় যে সব নবীদের সাথে হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) সাক্ষাত হয় তাঁরা হলেন-
প্রথম আসমানে মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) সাথে। হজরত আদম (আ.) সাথে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁর ডান দিকে নেককার এবং বাম দিকে পাপীদের রূহ বিশ্বনবী (সা.) কে দেখানো হয়। দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া এবং হজরত ঈসা (আ.) এর সাথে সাক্ষাত হয়। তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসূফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মূসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সাথে বিশ্বনবী (সা.) এর সাক্ষাত হয়। প্রত্যেকটি আসমানের দরজা হজরত জিব্রাঈল (আ.) খোলান এবং বিশ্বনবী (সা.) সাথে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন অতপর তাদের মধ্যে সালাম আদান প্রদান হয়। হজুর (সা.) আসমানে অবস্থানরত নবী (আ.) গণকে সর্বপ্রথম সালাম দেন এবং তাঁরা বিশ্বনবী (সা.) কে মারহাবা বলে মোবারকবাদ জানান।
এরপর হজুর (সা.) কে হজরত জিব্রাঈল (আ.) বোরাকে করে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে। কোনো রেওয়াতে আছে এখানে আরেকবার হজুর (সা.) কে ‘সিনা চাক’ (ফার্সী শব্দ) করা হয়। সপ্তম আসমানে হুজুর (সা.) এর সন্মুখে বায়তুল মামূর মসজিদ উন্মোচন করা হয়। যে মসজিদকে ফেরেশতাগণ তওয়াফ করতে আছেন। হাদীস শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭০ হাজার ফেরেশতা এই বায়তুল মামূর মসজিদ তওয়াফ করেন এবং যে দল তওয়াফ করেন সে দলের আর পুনরায় ভাগ্য হবে না এই মসজিদকে আবার তওয়াফ করতে। এখানে চিন্তা বিষয় হচ্ছে, তাহলে মহান আল্লাহপাক কত লক্ষ কোটি ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন তার হিসেব শুধু আল্লাহপাকই জানেন।
সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত যাওয়ার পর হজরত জিব্রাঈল (আ.) নবীজী (সা.) কে জানালেন, এরপর একহাত জায়গা অতিক্রম করার ক্ষমতা আল্লাহপাক তাঁকে দেন নি। যদি তিনি এই কাজটি করেন তাহলে তাঁর শরীরের নূরের ছয়শত পাখা আল্লাহপাকে নূরের তাজাল্লিতে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। বিশ্বনবী (সা.) কে এরপর রফরফ নামক বিছানায় করে আরশে আযীমে নিয়ে যাওয়া হয়। (সুবহানল্লাহি ওয়া বিহামদিহী)
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক ও পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী (সা.), যাকে আল্লাহপাক ‘আমার হাবীব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আরশে আযীমে তাদের সাক্ষাতের মূহুর্তে কেমন দৃশ্যের ও কী হয়েছিল তা আমার মত মানুষ তা বর্ণনা করার যোগ্যতা রাখে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, মেরাজ নিয়ে মহান আল্লাহপাক ও তাঁর প্রিয় নবী (সা.) যা বলেছেন এই বাইরে কেউ যদি কোনো কথা বলে থাকেন সেটা আমাদের বিশ্বাস করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা উক্ত স্থানে তখন মহান আল্লাহপাক ও তাঁর রাসূল (সা.) এবং অগনিত ফেরেশতারা ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। আর ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনো কথা বলার যোগ্যতা রাখেন না। অতএব কোরআন ও হাদীসের বাইরে কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে তা যতই যুক্তিযুক্ত বা মনোলোভা হোক না কেন।
আমি শুধু মেরাজে নিয়ে হজুর (সা.) কে কি কি দেখানো হয়েছিল এবং মহান আল্লাহপাক তাঁকে কী উপহার দিয়েছিলেন সেই বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ্। সম্মানিত পাঠকদের একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তাহলো- সিদরাতুল মুনতাহার পরে হজরত জিব্রাঈল (আ.) যদি এক কদম অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতেন তাহলে তার শরীর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত বলে তিনিই ব্যক্ত করেছেন। সেখানে আমার আপনার নবী, বিশ্বনবী (সা.) কে মহান আল্লাহপাক সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরের আরশে আযীমে নিয়ে গেলেন সেই নবীকে শুধুই মাটির মানুষ মনে করে তত্ত্ব উপস্থাপন করলে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে সে বিচার সম্মানিত পাঠকদের হাতে।
মেরাজের যে সব জিনিস নবীজী (সা.) দেখানো হয়ঃ-
১। আল্লাহপাকের সমস্ত সৃষ্টিকূলের রহস্য দেখানো হয়। আল্লাহপাকের শক্তির পরিধি কত বিস্তৃত তাঁর সৃষ্টি কত বিশাল ও অদ্ভুত তা দেখানো হয়।
২। জান্নাত দেখানো হয়।
৩। জাহান্নাম দেখানো হয়
৪। নহর দেখানো হয়। দুটো জাহেরী দুটো বাতেনী।
৫। জাহান্নামের ফেরেশতাদের সরদার মালেক কে দেখানো হয়।
৬। সুদখোর, যেনাকারীদের শাস্তি দেখানো হয়।
এছাড়াও মহান আল্লাহপাক তাঁর হাবীবকে যা ইচ্ছা করেছেন তাই দেখিয়েছেন এই বিষয়ে বর্ণনা করার অবকাশ নেই।
মেরাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহপাক যা যা নবীজী (সা.) দিয়েছিলেনঃ-
১। মহান আল্লাহপাকের সাক্ষাত লাভ। আমরা যারা নামাজের মধ্যে তাশাহুদ পাঠ করি অর্থাৎ আত্তাহিয়াতু পাঠ করি এই তাশাহুদটাই মহান আল্লাহপাক ও আমাদের নবীজী (সা.) এর মধ্যে কথোপকথন হয়েছিল আরশে আযীমে। সেই তাশাহুদ আমরা আজো নামাজের মাঝে পড়ে থাকি।
২। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উপহার দেওয়া হয়, ফরজ করা হয়। (৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব দেয়া হয়।) এখানে মেরাজ থেকে ফেরার পথে নবীজী (সা.) এর সাথে হজরত মূসা (আ.) সাথে সাক্ষাতের বিষয়বস্তু বিস্তারিত তুলে ধরলাম না। পাঠক মাত্রই তা জানেন বিধায়।
৩। সারা পৃথিবীর সৃষ্টিকূলের মধ্যে মানবজাতিকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মান প্রদান। সপ্তম আকাশ পেরিয়ে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি হুজুর (সা.) কে মহান আল্লাহপাক আরশে আযীমে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে এই সম্মান দিয়েছেন। যে সম্মানের গর্বিত সমস্ত মানবজাতি।
৪। মহান সৃষ্টিকর্তার ১৮ হাজার মাখলুকাতের সৃষ্টির রহস্য রজনীর একটি অতি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আমার আপনার নবী, বিশ্বনবী (সা.) কে দেখিয়ে আবার দুনিয়ায় সস্মানের সাথে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মহান আল্লাহপাক। নবীজী (সা.) মেরাজ থেকে ফিরে দেখেন, তিনি যে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেই দরজাটার খিড়কি তখনও দুলছে। যে পানি দিয়ে অজু করে গিয়েছিলেন সেই অজুর পানি তখনও নিচে গড়াচ্ছে! মহান আল্লাহপাকের কাছে এটা কিছুতেই অসম্ভব নয় সব আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতিকে স্তব্ধ করে করে দিয়ে নবীজী (সা.) কে মেরাজ করানো। জামানার মোজাদ্দের হজরত শাহ্ চন্দ্রপুরী নকশ্বন্দী মোজাদ্দেদী (র.) বলেছেন, ‘সময়েরও বরকত আছে, যা বিশ্বনবী (সা.) এর মেরাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে’।
৫। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য অনেক কিছু নবীজী (সা.) কে মেরাজের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে যা আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে বর্ণনা করা হল না।
মেরাজের স্বীকৃতি
মেরাজ থেকে ফিরে নবীজী (সা.) যখন ফজরের নামাজের পর তা বর্ণনা করতে ছিলেন, তখন কোরায়েশরা তাকে হাসি-বিদ্রুপের মাধ্যমে তামাশা করতে থাকে। তারা নবীজী (সা.) এর প্রিয়ভাজন হজরত আবু বকরের কাছে গিয়ে ঘটনা বলতে থাকে। হজরত আবু বকর তাদের কাছে জানতে যান, ‘আগে বলো কে এই কথা বর্ণনা করছে?’ তখন কোরায়েশরা বলতে তোমার নবী মুহাম্মদ। তখন হজরত আবু বকর বলেন, ‘যদি আমার নবী এই কথা বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্য বলেছেন’। হজরত আবুবকরের এই স্বীকার উক্তির মাধ্যমেই তাঁকে ‘সিদ্দিক’ অর্থাৎ সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তখন থেকেই হজরত আবু বকরের নামের শেষে সিদ্দিক উপাধি যুক্ত হয়ে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হয়।
এরপর কাফেররা বসে থাকে নি। তারা পুনরায় নবীজী (সা.) বিব্রত করতে ফিরে আসে তাঁর কাছে। নবীজী (সা.) কে প্রশ্ন করা হয় বাইতুল মাকদাসের দরজা, জানালা, সিঁড়ি নিয়ে। যদিও মেরাজের উদ্দেশ্য বাইতুল মাকদাসের জানালা, দরজা, সিঁড়ি গুনে রাখার মধ্যে ছিল না, তবুও কাফেরদের এমন প্রশ্নের উত্তর জানাতে মহান আল্লাহপাক হজরত জিব্রাঈল (আ.) এর মাধ্যমে পুরো বাইতুল মাকদাস মসজিদটিই হুজুর (সা.) সন্মুখে নিয়ে আসেন। হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহপাক বাইতুল মুকাদ্দাসকে আমার চোখের সামনে তুলে ধরলেন, আর তারা যা জিজ্ঞাসা করছিল আমি দেখে দেখে গণনা করে করে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম’।
তারপরেও কাফেররা তা বিশ্বাস না করে বরং তাঁকে যাদুকর হিসেবে আখ্যায়িত করে। এখানে ঈমান ও হেদায়েত দেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণই আল্লাহপাকের হাতে ন্যস্ত। সুতরাং অবিশ্বাসীদের মহান আল্লাহপাক হেদায়েত দেন নি।
মহাপবিত্র আল কোরআন হচ্ছে ‘সর্বকালের বিস্ময়ময় বিজ্ঞান’। মেরাজের সত্যতা আজ বিজ্ঞান শুধু স্বীকার করে ক্ষান্ত হচ্ছে না, চিকিৎসা শাস্ত্রে ওপনে হার্ট সার্জারি আবিষ্কার মেরাজের পথে হুজুর (সা.) এর ‘সিনা চাক’ এর ঘটনা থেকেই এসেছে। বিজ্ঞানীদের রহস্যময় মহাকাশ গবেষণায় মেরাজের সত্যতা আজ প্রমাণিত।
কেন বললাম মেরাজ না হলে মুসলমান চিনতাম না
শরিয়তে যতগুলো হুকুম হজুর (সা.) উম্মতের ওপর নাযিল হয়েছে তার সবই পবিত্র কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে নাযিল হয়েছে। একমাত্র শরিয়তে হুকুম ‘নামায’ যা মেরাজের রজনীতে মহান আল্লাহপাক আমাদের প্রিয় নবী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, নবীদের নবী, আখেরি নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরশে আযীমে ডেকে নিয়ে উপহার হিসেবে দিয়েছেন অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদের জন্য সালাহ্ বা নামায এক মহামূল্যবান উপহার তাঁর সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে।
এ জন্য হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- ‘আস্সালা-তু মী’রাজুল মু’মিনীন’ অর্থাৎ নামাজ হচ্ছে মুমিনীনের মেরাজ। পূবের্ই উল্লেখ করেছি মেরাজের রজনীতে মহান আল্লাহপাক ও নবীজী (সা.) সামনা সামনি বসে যে তাশাহুদ পাঠ করেছিলেন সেই তাশাহুদ (আত্ত্বাহিয়াতু) আমরা আজো নামাযের মাধ্যমে পাঠ করি। এক কথায় মেরাজে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মধ্যে যা যা ঘটেছিল আজোও একজন মুমিনীনের সাথে মহান আল্লাহপাকের নামাজের মাধ্যমে তাই ঘটে। এর বেশি আর বর্ণনা করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
তিরমিজী শরীফের হাদীসে আছে, ‘একজন মুসলমান ও একজন কাফেরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ’। আমাদের মাযহাবের ইমামগণ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ত্যাগ করলো সে কুফরি করলো। কুফরি আর শিরকের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ক্রমাগত কুফরের মধ্যে লিপ্ত থেকে কেউ মুসলমান থাকার যোগ্যতা রাখে না। কুফুরকারী তওবা করে কালেমা পড়ে পুনরায় ইসলামের মধ্যে দাখিল না হলে সে মুসলমান থাকবে না।
সুতরাং বলা যায় নামাযই একজন মুসলমানের পরিচয়। আমি মানুষ চিনি এভাবে যে নামাজ আদায় করে তাকে মুসলমান হিসেবে।
রাশেদ আজাদ
লেখক ও কলামিস্ট
০৬/০৬/২০১৩