বুড়ি কিছু মনে রাখতে পারে না। গোসল করে আসার পর গা শুকিয়ে গেলেই ভুলে যায় গোসল করেছে কি করেনি। এই জন্য মাঝেমধ্যেই তাকে দিনে দুই বা তিনবার গোসল করতে হয়। আবার কখনো কখনো গোসল না করেই গোসল করেছে ভেবে দিন পার করে দেয়।
বুড়ির এই বিস্মৃতিপ্রবণতা বুড়োর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বুড়ো আর বুড়ি—নিজেরা ছাড়া জগতে তাদের আর কেউ নেই। একসময় দুইটা ছেলে আর একটা মেয়ে ছিল। একটা ছেলে কাজের খোঁজে করাচি গিয়ে নিরুদ্দেশ। আরেকটা ছেলে ঢাকায় আছে বলে জানা গেছে। মা-বাবার খোঁজ নেয় না। আর মেয়েটা যে তাদের মেয়ে এই পরিচয় তারা দিতে চায় না। পরিচয় দিতে না চাইলেও মাঝেমধ্যে মনি অর্ডার করে পাঠানো তার টাকাটা পোস্ট অফিস থেকে গিয়ে তুলে নিয়ে আসে বুড়ো। একেকবার একেক শহর থেকে মনি অর্ডার আসে। বুড়ো ভাবে—আহ্, এত কিছুর পরও পোড়ামুখী কত ভাগ্যবান! কত শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটবেলায় বুড়োর মনে স্বপ্ন ছিল বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ানোর। জীবনের এই সায়াহ্নে মেঘনার পাড়ে বসে সে ভাবে, ছোটবেলায় ঠিক এভাবে বড় বড় পালতোলা মালবাহী নৌকা দেখত আর কল্পনা করত, এক দিন ওই সব নৌকার কাজ নেবে আর বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াবে। সারা জীবন ধরে গঞ্জের হাটে দিনমজুরি দেওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করা হলো না।
দিনমজুরির কথা মাথায় আসতেই খেয়াল হলো আজ বুধবার। তড়িঘড়ি নদীর পাড় থেকে উঠেই সে ছুটল বাড়ির দিকে। আজ বুধবার। ভাবতেই বুড়োর গায়ে জ্বর এসে যাচ্ছে। আজ বুধবার। বুড়ির বিস্মৃতিপ্রবণতার সুযোগ নেওয়ার সময় এখনই।
দুপুরের সূর্য মাথায় নিয়ে বাড়ি পৌঁছেই বুড়ো দেখল ঘর তালা দেওয়া। বুড়ি কাজে গেছে। ঠিকা কাজ না বলে গোলদার মিয়ার বাড়ি বেড়াতে গেছে বলাটা অধিকতর যুক্তিসংগত। বুড়ির মাথার যা অবস্থা, তাতে তার পক্ষে গৃহস্থালি কাজ তো গুছিয়ে করা সম্ভব না। কিন্তু এতকাল ধরে কাজ করেছে। তাড়িয়ে দেওয়া যায় না বলেই গোলদার মিয়ার স্ত্রী বুড়িকে রেখে দিয়েছে। বুড়ি গিয়ে এটা-সেটা করে, পান খায় আর মাস শেষে কিছু টাকা পায়। ওই টাকাটা আর প্রতি মাসে নিত্যনতুন উপায়ে ধারকর্জ—এই দুই মিলিয়ে টেনেটুনে চলছে দুজনের জীবন। ও, আরেকটা খাত তো আছে! তিন মাসে, ছয় মাসে একবার পাঠানো মেয়ের মনি অর্ডার। এই জোড়াতালিতে ত্যক্ত-বিরক্ত বুড়ি প্রায়ই বুড়োকে গঞ্জনা দেয়। বুড়োর শরীরে কুলায় না। তবুও বুড়ি তাকে ঠেলাঠেলি করে বৃহস্পতিবার সকালে গঞ্জের কামলার হাটে যেতে। আজ বুধবার। কাল বৃহস্পতিবার।
ঘরের চালের নিচে লুকানো চাবিটা বের করে বুড়ো ঘরে ঢোকে। কাঠের তক্তা দড়িতে বেঁধে বানানো তাকটার কাছে যায়। তাকের ওপর দুইটা স্বচ্ছ কাচের বয়াম আছে। দিন গোনার সুবিধার জন্য একটা বয়ামের ভেতর সাতটা মার্বেল রেখেছে বুড়ি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে একটা করে মার্বেল পাশের বয়ামটাতে রাখে। গত কয়েক বছর জগতের আর কোনো কাজ খেয়াল করে ঠিকমতো করতে না পারলেও এই একটা কাজ সে ঠিকমতো করে। কারণ, তাকে জানতে হবে কবে বৃহস্পতিবার। বুড়ো হুড়োহুড়ি করে ঘরে ঢুকে স্রেফ বাম দিকের বয়ামটা ডান দিকে আর ডান দিকেরটা বামে করে দিয়ে আশায় থাকে, বুড়ি এসে বিভ্রান্ত হবে আর বুড়ো হাতে আরও কয়েকটা দুশ্চিন্তামুক্ত দিন পেয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা এমন না যে বুড়ি কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবে না যে আজকে কী বার! তবুও বুড়ো গঞ্জের হাটে যাওয়ার হাত থাকে বাঁচার জন্য অবলম্বনহীনের একটা অবলম্বন হিসেবে এই চেষ্টাটা মাঝেমধ্যে করে। এভাবে কখনো কখনো সাফল্যও পায়। এভাবে কখনো কখনো সে সপ্তাহকে পনেরো দিনের বানিয়ে দেয়। এভাবে কখনো কখনো আচমকা ছুটি পেয়ে নিরুদ্দেশে বেড়িয়ে আসে ‘বৃহস্পতিবার’।
বৃহস্পতিবারকে এত ভয় কিসের বুড়োর? বৃহস্পতিবার কি শুধুই ভয়ের? নাকি পরাজয়েরও? সারা জীবন জগতের সব কাজকে প্রবল শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে পরাভূত করলেও এখন কাজের কাছে হারতে হয় তাকে। শরীরে কুলায় না। কামলার হাটে যাওয়ার সময় তাই তার পা চলে না। হাটের মুখের মসজিদে ঢুকে নামাজ আদায় করে সে মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্নার খমকে আল্লাহর আরশসহ কেঁপে ওঠে। আল্লাহর কাছে তার একটাই আরজি—কোনো গাহাক যেন তাকে পছন্দ না করে। মাঠের কাজে নামলে সে আর জান নিয়ে উঠতে পারবে না। দম বের হয়ে যাবে।
হাটে গিয়ে শত শত কামলার ভিড়ে পেছনের সারিতে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে বুড়ো। যখনই কোনো গাহাকের চোখ পড়ে তার ওপর, সে আলগোছে মাথাটা তার সামনে বসে থাকা তাগড়া কামলার পেছনে আড়াল করে ফেলে। এ রকম লুকোচুরি খেলতে খেলতে সূর্য পড়ে আসে। হাট ভেঙে যায়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সে। যাক, আল্লাহ তার আরজি শুনেছে।
বাড়ির দিকে পা চালায় সে। অন্ধকারে ভর করেছে গ্রামের পথে। এই অন্ধকারেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তার বাম চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চিকচিক করছে ধারাটা। আস্তে আস্তে ফোঁপানির শব্দ বাড়তে থাকে। নির্জন রাস্তায় বেতফলের মতো করুণ অন্ধকারে সেই ফোঁপানির শব্দ অসহ্য রকমভাবে বাজতে থাকে। কান্নার ঢেউ বাড়তে বাড়তে গোঙানির পর্যায়ে চলে যায়। এই কান্না পরাজয়ের। যে বুড়ো এতক্ষণ চাইছিল, কেউ যেন তাকে না কিনে নেয়, সে-ই এখন কাঁদছে কেউ তাকে কিনে না নেওয়াতে। নিজেকে অপাঙেক্তয় ঠেকছে তার। পরিত্যক্ত ঠেকছে। আল্লাহর ওপর রাগ করলে গুনাহ হবে জেনেও তার ভীষণ রাগ হয়। কেন সে বুড়ো হলো? কে তার শক্তি কেড়ে নিল? কে মাংসপেশিগুলো ঝুলিয়ে দিল? কে তার কদর কেড়ে নিল? সে জানে বিক্রি না হয়ে বাড়ি ফেরাতে বুড়ি তাকে বকবে না। বুড়ি ঠিকই পরম মমতায় ভাত বেড়ে দেবে। কিন্তু সে তো বুড়ির কাছে একটা অচল পয়সা হিসেবে যেতে চায় না। সে তো সচল মুদ্রা হতে চায়, যাতে বুড়ি তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে। বুড়িকে দেওয়ার আর কী-ই বা আছে তার?
গর্ব করার মতো কিছু না-হয় না-ই দেওয়া গেল। পরাজয় দেওয়া কেন তবে? সেই জন্য পরাজয়ের হাত থেকে দূরে থাকতে বুড়ো বৃহস্পতিবারকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডান পাশের বয়ামকে বাম পাশে আর বাম পাশের বয়ামকে ডান পাশে করে সে চুপচাপ শুয়ে আছে বুড়ির আসার অপেক্ষায়।
হঠাৎ কী এক অদ্ভুত কারণে তার অপরাধবোধ জেগে ওঠে। সে উঠে গিয়ে বয়াম দুটোকে আবার আগের জায়গায় ফেরত নিয়ে আসে। মনকে শক্ত করে সে। ‘নাহ্, কাইল হাটে যামুই।’ বিড়ির তৃষ্ণা চাপে তার। বিড়ির প্যাকেট ফাঁকা। ঘর থেকে বের হয়ে চায়ের দোকানের দিকে যায় সে।
এদিকে বুড়ি ফিরে আসে। ঘরে ঢুকে প্রথমে তাকের দিকে তাকায়। বয়ামগুলো আগের জায়গায় আছে। সে একটু অবাক হয়। বোকা বুড়ো আজকে বয়াম ওলট-পালট করল না কেন? তারপর নিজেই বয়ামগুলো ওলট-পালট করে দেয়।
বিড়ি টানতে টানতে ফিরে আসে বুড়ো। ঘরে ঢুকেই খেতে বসে। বুড়ি খাবার বেড়ে দেয়। বুড়ো খেতে খেতে একটু অবাক হয়ে খেয়াল করছে বুড়ি এখনো কালকে হাটে যাওয়ার কথা বলছে না কেন? বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে চকিতে তাকের দিকে তাকায়। এ কি!! বয়াম ওলট-পালট করল কে? সে কি ওলট-পালট করার পর আবার আগের জায়গায় ঠিক করে রাখেনি? কিন্তু সে তো বিড়ি কিনতে যাওয়ার আগে ঠিক করেই রেখে গিয়েছিল। নাকি রাখেনি? ধন্দ লাগে তার। তবে কি সেও বুড়ির মতো সব ভুলে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় বুড়ির দিকে তাকাতেই সে বুড়ির চোখে সব উত্তর খুঁজে পায়। পঞ্চাশোর্ধ্ব দুই বৃদ্ধের নির্বাক চাহনিতে কী এক বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যায়। চোখে চোখে কত কথায় মুখর হয়ে ওঠে তারা। দুজনের চোখই ভিজে আসে। কী এক অপার্থিব পুলকে ভরে ওঠে তাদের শরীর-মন। কোনো সঙ্গম তাদের এত আনন্দ, এত শান্তি দিতে পারেনি কোনো দিন!