বউদির চান ঘরে গান ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও, মোর প্রাণে গোপনে গো’
‘… তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা।
তোমার চাঁদের আলোয়/ মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান’। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
- দোল এলে এমন হয়।
- কেমন হয়! এমন মানে কেমন ফকির?- এমন মানে এমন! তোমার হয় না রঞ্জা?
- হয় তো! সে তো ভিতরমহলে… একটা উসখুসানি হয়। সে উসখুসানি বুনো মেঘের ঝড়ের আন্দাজে, দখিনা বাতাসের তছনছিয়া রূপ তার। তোমার?
- এই ধরো বসে আছি মনকেমনের বিকেলে, স্থির-চুপটি করে। তোমাকে ফোন করব, এই ভাবছি আর ভাবছি। ফোনটা আলসেমি করে তুলে রেখেও দিলাম। মানে কেন যে রেখে দিলাম! রেলিং-এ ঠিক অমন সময় চাঁপা গাছের ঝাড় চৈত্র হাওয়ায় ঝিরঝির নড়ল। নড়ল যেই, হঠাৎ মনে পড়ল, উলটো দিকের ফ্ল্যাটের বদনামি মুন্নির কথা। উলুখুলু ওর দামাল তেইশ ভাবতে ভাবতেই মনে হল, ওর লাল দোপাট্টায় দুটো গাং-শালিক বসেছে বুঝি!
- তুমি বুঝি ফিসফিসিয়ে বললে, ‘হুস, পাখি হুস’!
রঞ্জা আজ দারুণ খিল্লির মুডে। দিন-কাল বুঝে ও মেতেছে আজ ম্যাট কালারের মাতনে। পিচ স্লিভলেস টপের সঙ্গে গ্রিন হট প্যান্ট পড়েছে। স্লিভলেস টপ যেন ফিচেল ফতুয়ারই সাঙাত। হলফলে হটপ্যান্ট যেন হরিলুটের দোসর! ওর ঠোঁটে চেটেপুটে আমারই খাওয়া মিঠে রঙের মধু-নির্যাস। খোলা চুলের বাঁকে, দখিনা বাতাসের বাংলা খেয়াল। রঞ্জার নির্লোম উরুর দিকে যত বার চোখ গেল, মতি বলল, নষ্ট হওয়ার নসিব সুনিশ্চিত এ মধুমাসে!
দোলের আগে এমন শনিবারিয়া নিশিঠেকে রঞ্জাবতীকে এমনি করে পাব, ভাবিনি। সকাল সকাল ঠেক জপাতে জমে গেছে ফকিরের এক চিলতে আখড়ায়। ওর মর্জি বলছে, আজ ঠেক চলবে আখড়াতেই। এসে থেকেই দেখো না, ঢকঢকিয়ে বিয়ার খাচ্ছে। আর আমার বই-পত্তরের ভিড় থেকে কবিতার খাতা উদ্ধার করছে। রঞ্জার এই ঢকঢকিয়ে বিয়ার খাওয়া দেখে বিড়বিড় করে বললাম, ‘গোল্লায় গেছে মেয়েটা, চাট্টি খানি বয়েস’!
ওর চোখের হরিণকে আমি চিনি! শুনেও যেন শুনল না মেয়ে। নেলপালিশ পড়তে পড়তে উল্টে আমার কোলে এসে বসল, হামলে। তারপর ঠোঁট থেকে আস্ত সিগ্রেটটাই ছিনতাই করে নিল! রে রে করে আঁতকে উঠে বললাম,
- এ কি! গোটা, মানে সবে তো ধরিয়েছি একটি!
ও শান্ত নিবিড় সুখটান দিতে দিতে বলল,
- সুখের জন্য হাত পাতলে নাকি আগুন দিই তোমায়? এবার সেই আগুন বরং খাই নিজেই। কাউন্টার দেব। তাছাড়া, তুমি তো ইন করো না। নষ্ট করে কী লাভ বলো, যা দাম বেড়েছে!
কেস খেয়ে চুপ করে গেলাম। সত্যিই মানে, ওর কথাটা সত্যি! বেশ কয়েকবার ও দারুণ আগ্রহ নিয়ে আমাকে ব্যাপারটা রপ্ত করাতে উঠে পড়ে লেগেছিল। গোটা গোটা প্যাকেট ফুরিয়ে শিক্ষানবিশির চোটে শেষে একদিনেই যক্ষ্মা হওয়ার যোগাড়!
সিগ্রেটের মায়া ছেড়ে অনির্বাণের কাবলে ফোনের তাগাদা থেকে বাঁচতে দ্রুত শেষ টানছিলাম লেখাটার। রঞ্জার খপ্পর বাঁচিয়ে লেখা যে কী যাতনা সেটা এই ফকির-ই জানে! ওকে নিয়ে কী গসিপ লিখছি, কোলে বসে সিগ্রেট সুখ টান দিতে দিতে দেখছিল সেটাই। সেটা দেখতে গিয়ে দুটো আস্ত প্যারা বেমালুম উড়িয়ে দিল উড়ুক! এমন আগেও হয়েছে। লাল হওয়ার কথার বদলে ছিঁড়ে কুটুকুটি করেছে কত কবিতা! শুধু কি তাই? সিগ্রেটের ছাই ফেলে এখন দিব্যি বাংলাদেশি টি-শার্ট পোড়াল! ফকিরকে ক্যাবলা করা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল,
- ওই যাঃ! তোমার হৃদকমলে আগুন! কী যেন বলছিলে, বসন্ত এলে…
খেই হারিয়ে ওকে মাখতে মাখতে সাজ-খসাবার দোল খেললাম দীর্ঘক্ষণ! রঙিন হয়ে রঙ ঘুচালো একসময় ও। যেন ঝুমকোলতা! ঠিকানায় ফিরতে ফিরতে বললাম,
- ধরো, এই আজকের গঙ্গাজল সকাল। লাগালাগি ফ্ল্যাটের ‘বদমাইশ’ বাবলি বউদির চান ঘরে গান শুনছি! বসন্তের ওই গানটা। ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও, মোর প্রাণে গোপনে গো’।
- প্লিজ!
- শোনো না, ঠিক তখনই তুমি এলে। বাসন্তিক সকালে যেন রবিঠাকুরের বসন্তের সব গানও ভেসে এল শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গন থেকে। দখিনা বাতাসে দোলের শতকণ্ঠের গান ঘিরে ধরল আমার চারপাশে। মর্মরিত সুর যেন থেকে থেকে সুখি ঠোক্করে মনের মন্দরে তুমুল দোল জাগাল। মনে হল, লাগল যে দোল!
- এই জানো, ক’দিন খুব মনে পড়ছে শান্তিনিকেতনের কথা। ফকির নেশাটা ঠিক জমছে না জানো, চলো দু’ পাত্তর ভদকা খাই। তুমি বসো, বানিয়ে আনছি…
- রঞ্জা দোলের নেশায় ভদকার কিন্তু কোনও জবাব নেই! বেলা যত বাড়ে এ নেশা তত চড়ে। গরমের মধ্যে তুমি রাম বা হুইস্কিতে যেতে পারো, কিন্তু মিঠে রঙের রঙিন মেজাজ হারাবে। তোমার মনে আছে, গতবার-ও শান্তিনিকেতনে পাঞ্চ করে নিয়ে গিয়েছিল সুরজিৎদা-নিপুদারা।
রঞ্জা দু’ পাত্তর ভদকা নিয়ে এল। একটি করে দীর্ঘ লালি লঙ্কা দু’ফালা করে চিরে গহনে তলিয়ে দিয়েছে ও পানপাত্রের মধ্যে। কোহলের অতলে মহার্ঘ্য তার দৃশ্যসুখ! বলল,
- সে আর মনে নেই, কালো বাড়ির সামনে, বুদ্ধ মূর্তির নিচে তারপর সেই নাচ। বাসুদেব দাস বাউল গাইছিলেন এক পায়ে ঘুঙুর বেঁধে। ‘হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না’!
- ওখান থেকে সীমান্তপল্লির ক্যাম্পে… টুটুলদির বাড়িতে গিয়েছিলাম। জানো, সে বাড়িটা আছে, ব্রতীনদা আছে, বাবুই আছে, গেটের এক পাশে মাধবীলতার গাছটাও আছে। কেবল টুটুলদি নেই! এবার আর যাওয়া হবে না সে বাড়িতে! ‘কত শত ফুল ছিল হৃদয়ে, ঝরে গেল, আশালতা শুকালো-/ পাখিগুলি দিকে দিকে চলে যায়’। টুটুলদি নেই!
দোলের সকালের নেশা ও বিকালের নেশা যেন সমঝেই ভাগ করে দিত টুটুলদি। সকাল-দুপুর ভদকা। দুপুর ফুরিয়ে গঞ্জিকা। আর সন্ধে রাতে রাম অথবা হুইস্কি। সেই মোতাবেক দুপুরে নানা ধরনের মাছভাজা। রাতে চিকেন বা মাটন। মনে পড়ছিল সে সব কথা। রঞ্জাও ফকিরের মতো সীমান্তপল্লির লাল কাঁকুড়ে পথের স্মৃতির বাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে…! ওর চুলের মধ্য ঠোঁট ডুবিয়ে প্রিয় ঘাড়ে চুমো খেতে খেতে বললাম,
- দোলের দিনে দিনভর জলে ডুবে সেই আড্ডাটাই প্রাণ ছিল জানো!
- সিদ্ধি-ভাঙ এসবের বেশ গল্পও রয়েছে। একসময় তো বহুবাড়িতে দোল একটা পার্বণ বলেই প্রচলিত ছিল। নানা রকম গল্প-ও তৈরি হয় এখনো। তৈরি হয় নানা নতুন সম্পর্ক!
কথা বলতে বলতে কখন যে রঞ্জা ওর মুঠোয় ফাগ তুলে নিয়েছে…! সেই রঙে মেতেছে ও ফকিরকে রাঙাতে। বিলোল চাহনির চোখের পাতায় চুমো খেতেই মেয়ে বিলোল তৃপ্ত আলিঙ্গন! তারপর ঘাড়ে, মুখে, চুলের ডালপালায়, সারা শরীরে রঙে রঙে রাঙালো ও মদির হেসে। নাছোড় ফকিরও ফাগ নিয়ে উপুড় করল হাত ওর বেয়াড়া শরীরে। একটু একটু করে ওর চোখের পাতায়, চিবুকে, চিবুকের তিলে ফাগের গুঁড়ো তিরতির। যেন পিয়াল ফুলের রেণু! ওর সর্বাঙ্গের উদ্যমে, অভিলাসে, বাসনায়, বৃন্তে মাখিয়ে দিচ্ছি বসন্তের রঙ নিবিড় করে। সবখানে রঙ। রঙ যেন ওর মর্মে লেগেছে সৌরভের শিখা জাগিয়ে! বললাম,
- দুজন মানুষ এমনি করে দোলের দিনে চুরমার করে বুঝি সাতমহল! গড়ে নতুন ‘দুঁহুঁ’!
- ‘দুঁহুঁ’ কী?
- তোর মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা চাহনি। তোর চাঁদ মুখের আলো। যেখানে মিলায় দু’জনের দুঃখ, যেখানে সুখের সকল অবসান!
- ক্রমশ…
লেখক : আবীর মুখোপাধ্যায়