পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন/এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা/পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম (জয় গোস্বামী)
- ফকির তুই কোথায়? কিচ্ছুটি ভাল্লাগছে না! কী রে, বল! কোথায়?
- হমমমমমম… এই তো… কপিটা ছেড়ে কাটব!
- কই তো!
- আজ আন্তর্জাতিক চুমু-দিবস! চোখ বন্ধ করে একটা স্মুচ কর, দেখ তোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছি!
- ধ্যাত! দুষ্টুমি ফের! .. দিবস! রোজই তো চুমু-দিবস। এই ফকির তোর কাছে টাকা আছে?
- খিক খিক! হাসালি রঞ্জা! জানিস তো মাধুকরী ফকিরের সম্বল। টাকা কোথায়?
- উঁহু! বল না রে… লোন দিবি? দিবি-দিবি?
- ‘তোমায় আমি দিতে পারি নৌকো-ভাসা নদী,/ মাটির কৃষ্ণ চড়কমেলায় কেনা।/ আমার কাছে কোনো কিছু কখনো চাইলে না’! কত?
- রতনতনু টুকিস না শালা! কত নয়, মদ খেতে ইচ্ছে করছে খুউব! কী ছোটোলোক হয়ে যাচ্ছি না? ফোন করে দিনে দুপুরে মদ খাওয়াবার জন্য জ্বালাচ্ছি! নষ্ট মেয়ে হয়ে গেছি ফকির… নষ্ট মেয়ে!
- হেব্বি বস! ফের সেই সোশিও-ইকোনমিক্যাল সেন্টু-জপ, ফকিরের কিন্তু দিব্য লাগছে। কী জানিস, তোর মধ্যে এই মোদোমাতাল পাগলিটাকে দারুণ লাগে। তুই লোলো একটা, কাছে আয়!
- তুই আয় কাঙাল! ১৭ বি, পার্ক স্ট্রিটে।
- কলকাতা ১৬! জিওওওওওওওওওওও গুরু… ট্রিঙ্কাস! তোকে আদর আদর! নিশিতে পেয়েছে রঞ্জা, পনেরো মিনিটে আসছি। ফুটের দিকের শার্সির পাশের টেবিলের একটা ধরে রাখ!
ভোকাট্টা হয়ে কাটছি! চাঁদনি চক টা-টা! নিশি… নিশিতে পেয়েছে ফের আজ। লিফটে নামতে নামতে হোয়্যাটস আপের চ্যাট উইন্ডোয় রঞ্জাকে চুমদার ঠোঁটের একটা স্টিকার ভাসিয়ে সটান ফুটপাতে পা। আচ্ছা, রঞ্জা যে ফকিরকে কাঙাল বলে, সে তো প্রমোদ বসুর সেই লাইনটার মতো, ‘তুমি আছো এ কথা এখনো মানি,/ প্রেম শুধু থাকে ভিক্ষুক হয়ে মনে’।
মাঝে মাঝে ওকে নতুন করে, নতুন কোনও নামে ডাকতে ইচ্ছে করে। আজ যেমন ডাকতে ইচ্ছে করছে ‘রাই’ বলে! সত্যিটা হল, ভালবেসে সব নারীকেই সমান সুন্দর মনে হয় ফকিরের। সেই জন্য ক্লান্তিহীন এই ভাললাগা। এই তো আজ, সেই পুলক। যেন নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে! ট্যাক্সি…
যেতে যেতে মনে পড়ছিল কয়েক বছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ঊষা উত্থুপের একটা ইন্টারভিউয়ের কথা। সেখানে ছিল ট্রিঙ্কাসে ওঁর সিঙ্গার জীবনের কথা। …পার্ক স্ট্রিটের ‘ট্রিঙ্কাস’-এ তখন রমরমা। … অফার এল ওখানে গাওয়ার। কিন্তু আমি প্রথমেই বলে দিয়েছিলাম শাড়ি পরে গাইতে দিলে আমি রাজি। ঠিক হল মাসে আমাকে দেওয়া হবে দেড় হাজার টাকা। দিনে তিনটে সেশনে গান গাইতাম টি, প্রি সিনেমা আর পোস্ট সিনেমা। একদিন, গানের শেষে কনফেকশনারিতে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সুন্দর কাপল দেখে! সেদিনই প্রথম জানলাম দু’জন উত্তম-সুপ্রিয়া!…
তুখোড় জ্যামে জড়িয়ে গেল ট্যাক্সির চাকা! রঞ্জা ফকিরের জন্য অপেক্ষা করে আছে। ফকিরের অপেক্ষা ভাল লাগে। যে কোনও সম্পর্কে অপেক্ষা থাকতে হয়। কারও জন্য পথও চাওয়াতেও প্রেম দীর্ঘজীবী হয়। তাতে পরস্পরের মধ্যে মনকেমন বাড়ে। মেঘে মেঘে ফুরন্ত বেলার সিগন্যালে একাকী জর্জ বিশ্বাসের গলা। বর্ষার ওই গানটা ফের শুনছি। মিশ্র গৌড়মল্লারে জর্জ গাইছেন, ‘আজি শ্রাবণঘনগহনমোহে/ গোপন তব চরণ ফেলে/ নিশার মতো নীরব ওহে,/ সবার দিঠি এড়ায়ে এলে’।
রঞ্জাবতী চুপটি করে বসে থাকবে, এতটা ভাবা ফকিরের নিছক বাতুলতা। ছটফটিয়ে সে মেয়ে বিন্দাস এরই মধ্যে ভাব করেছে ট্রিঙ্কাসের বুড়ো বারটেন্ডারের সঙ্গে। মেনু হাতে গল্প জুড়েছে অন্দরবেলার কথায়। ওদের মশগুল গল্পে উৎকর্ণ হয়ে ঢুকে গেলাম। কথার মাঝে দেখছিলাম, ট্রিঙ্কাসের ভিতরমহল। দুটো লার্জ বিপি, সঙ্গে চিকেন লসুনি কাবাবের অর্ডার করে চোখ গেল খাসমহল থেকে একপেশে একটা দিকে কালো কাচ ঘেরা বসার জায়গায। লাগোয়া সে বসার জায়গা, মিং রুম। বোঝা গেল, ওখানে ট্রিঙ্কাসের জগঝম্প বা, সুর-সারিন্দা কোনওটাই পৌচ্ছয় না। নিভৃতে কথাচারিতার জন্য সুখদার নিলয়। খাসমহলে তখনও তেমন ভিড় জমেনি। একজন গিটারিস্ট সুর বাঁধছেন সবে। রহিস অন্দরমহলের সবখানে ঝিলমিল সেই সুর আর সুরা-স্নিগ্ধ সন্ধের দীপালোক। বিলাসিতায় মোড়া চারপাশ থেকে পৃথক, স্টেজের ঠিক সামনেই সিলিং থেকে ঝুলছে একটা ‘হাজার টাকার’ ঝাড়বাতি! টেবিলে টেবিলে লাল গোলাপ!
গোলাপ দেখাতক মাথায় সত্যেন দত্তর অনুবাদে হাফিজ ঘুরছিল। এলোমেলো কেবল মনে পড়ছে, পাবলো নেরুদার ‘গাথা ও বিলাপ’। রঞ্জার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বললামও মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের সেই চমৎকার অনুবাদ,
- ‘ও মেয়ে, গোলাপবনের মেয়ে, উষ্ণ কোমল পারাবতের বুক,/ বুকে বন্দী মাছ, গোলাপলতা/ লবণাক্ত তৃষ্ণাভরা গেলাসে তোমার হৃদয়/ পুঞ্জ পুঞ্জ আঙুরে টসটসে তোমার ত্বক’।
যেন বিদ্যুৎলতা! লজ্জা পেয়ে ছিটকে গেল রাইকিশোরী। চোখ গেল ওর উদ্ধত বুকের কালো টি-শার্টে। সেখানে লালনে লেখা ধুলোটিয়া কথা-কলি, ‘হৃদমাঝারে’। কী করে ছাড়ি বলুন তো এ মেয়েকে? না, না ‘হৃদয়ে রাখব’! একটা শরীর সংলিপ্ত ফেডেড নীল জিন্স পরছে আজ। দু’ হাতে সেই কাঠুরিয়া বিডস-এ ‘যেমত যোগিনী-বালা’! ওর হাতের মুঠো খুলে গন্ধ নিলাম। দীর্ঘক্ষণ মুঠো করে রাখলে, ওর হাতে পদ্মবনের গন্ধ পাই। এখন পেলাম, সেই গন্ধটা আবার!
হুইস্কির পেগ নিয়ে ফিরল বারটেন্ডার। রঞ্জা বরফ নেয় না, কেবল জল। ফকিরের শুধু-ই বরফ। রঞ্জার ইন্ধনে ডাউন মেমোরি লেনে হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘সেই বছর বচ্চনের প্রথম ছবি এল হলে। গলা শোনা গেল’। রঞ্জা আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,
- সে তো ষাটের দশকের শেষ। ৬৯?
- মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ না ছবিটার নাম…
- সলিড বস, একদম ঠিক। সে ছবিতে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিগ বি-র গলা শোনা গিয়েছিল প্রথম বার। সেই বছরেই মুক্তি পায় সত্যজিৎতের ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’।
- সেবার কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল আরও একটা বিখ্যাত ছবি। হরিসাধন দাশগুপ্তের। মনে আছে নামটা? আচ্ছা একটা কিউ দিচ্ছি… হিট জুটি!
- ইয়েস! উনসত্তরে উত্তম-সুচিত্রার ‘কমললতা’।
৬৯ শুনে যেন চোখে বাতি জ্বলে উঠল প্রবৃদ্ধ বার টেন্ডারের। বললেন,
- সেই বছরই মুম্বই থেকে একুশ বছরের তামিল মেয়ে এখানে গান গাইতে আসে। ওঁর স্বপ্ন ছিল নাইট ক্লাবে গাওয়া। কাঞ্জিভরম শাড়ি পরা সেই মেয়েটির গান, কলকাতার এলিট সোসাইটির নজর কেড়েছিল সেই সময়। মেয়েটার নাম ঊষা। ঊষা উত্থুপ!
- সেই নাইটক্লাব…?
- ট্রিঙ্কাস!
ফের মনে পড়ল ইন্টারভিউটার কথা। রঞ্জাকে বলতেই ও শুধাল ফকিরকে। স্মৃতি থেকে বলতেই হল,
- জানো, ‘ট্রিঙ্কাস’-এই ঊষাদির সঙ্গে প্রথম দেখা হয় বচ্চন সাহেবের। বন্ধুদের নিয়ে আসতেন গান শুনতে। সত্যজিৎ রায়ও এসে পড়তেন মাঝে মাঝে। এঁদের এক -একজনের আবার এখানে গান শোনার পছন্দও ছিল এক-একরকম। পত্রিকার ইন্টারভিউতে ঊষাদি বলেছিলেন।
- কীরকম শুনি?
- উত্তমবাবুর ফেভারিট গান ছিল ‘ফিভার’। আবার শর্মিলা ঠাকুর-পটৌডিসাহেবের পছন্দ ছিল ‘মাটিল্ডা।’ ঊষাদির গলায় রবিঠাকুরও শোনা যেত। ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। ট্রিঙ্কাসের সুদীর্ঘ ইতিহাস জানো, বেশ রোমাঞ্চকর। ১৯২৬-এ দুই সুইসসাহেব; মিস্টার ফ্লুরি এবং মিস্টার ট্রিঙ্কাস; যৌথভাবে পার্ক স্ট্রিটে ‘ফ্লুরিস অ্যান্ড ট্রিঙ্কাস’- এর স্থাপনা করেন। প্রায় এক দশক পর, মিস্টার ট্রিঙ্কাস আরেকটি ‘টি-রুম’ খোলেন একই রাস্তার পিঠোপিঠি। বসে আছি সেখানেই। ১৯৫৯-এর আগে পর্যন্ত এটা ছিল নিছক ‘টি-রুম’-ই। কেন না, ১৯৫৯-এ হল হাতবদল। এলিস জোশুয়া এবং ওম প্রকাশ পুরি যৌথভাবে মিস্টার ট্রিঙ্কাসের কাছে থেকে কিনে নিলে বদলে যায় এই চা-খানার চরিত্রও।
দু’জনের কথার মাঝে কখন যে গান শুরু হয়েছে! একের পর এক গান গাইছেন ঈষৎ পৃথুলা এক সুন্দরী। টেন্ডারের কাছে নাম জানলুম, সিক্কা। মুগ্ধ হয়ে শুনছি। পেগ ফুরোচ্ছে। ছটফটি, উড়ুক এখন চুপ! বরফের শরীরে ডুবে থাকা তলানি মদটুকু গলায় ঢেলে, দু’টো লার্জ রিপিট করতে বললাম চুপিচুপি। সাহসী আঙুলে রঞ্জার গুরু নিতম্বে হাত রাখলাম বেড় দিয়ে। আরডি-র করা শেষ সুর গাইছে সুন্দরী সিক্কা! ১৯৪২ আ লাভ স্টোরি। ‘দিল নে কহা চুপ কে সে,/ ইয়ে কেয়া হুয়া চুপ কে সে’!
শুনতে শুনতে একসময় বোধের ভিতর দেখছি বুঝি একটা পুরো দশক। বর্মা থেকে কলকাতায় সদ্য পা রাখা এই শহরের নিশিনিলয়ের এক নর্তকী। উদ্ভিন্নযৌবনা হেলেন! ঝাড়বাতির শত-সহস্র প্রতিবিম্বে না না, ও হেলেন নয়, ও তো লিডো লুপ্ত যুগের এই শহরের রজনীঠেকের শেফালি! শরীর-জাগানোর মন্ত্র-সুরে মধুশালার মখমলে নৃত্যরতা সফেদ-নগ্নিকা যেন বলছে, ‘এসো পাপ করি’!
মুখে-চোখে জল দিতে উঠেছিলাম। ওয়াশরুম থেকে ফিরতি পথে প্রিয় বন্ধু মল্লিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সহৃদয় শিল্পী, দিলদার তাপস মল্লিক! বহুদিন পর দেখা!
- মল্লিক না!?
ক্রমশ…
-আবীর মুখোপাধ্যায়