Search  



                                               

                                           

Md. Mamunur Rashid

Home  |  Bangladesh  |  হাসা-হাসি  |  ইসলাম  |  গল্প  |  

FacebookTwitter


 

Home >> দুঃখিত
নেয়ামত উল্লাহ সাহেব বললেন, ‘কী বলব বাবা, আমার মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র ভালো না।’
শুনে চমকে উঠলাম। কোনো বাবাকে তাঁর মেয়ে সম্পর্কে এ রকম কথা বলতে আগে কখনো শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো না মানে? কী করেছে?’
নেয়ামত উল্লাহ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশ্রুসিক্ত হয়ে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, কম বয়সে মা হারানো মেয়েটাকে অতি আদরে মাথায় তুলেছেন তিনি। এখন নামাতে পারছেন না। মাত্র এইচএসসি ক্লাসের ছাত্রী, এর মধ্যে তিন-তিনটি দুর্ঘটনা! ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রেমে পড়েছিল পাড়ার এক রোমিওর। এসএসসি পরীক্ষার পর ছুটিতে নানাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে প্রেমে পড়ল ফোন-ফ্যাক্সের এক দোকানদারের। এ দুটো ঘটনা তবু অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। তৃতীয়টা আরও জটিল। নিরাপত্তার নানা দিক বিবেচনা করে মেয়েকে মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন নেয়ামত উল্লাহ। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে। ফার্স্ট ইয়ারে মেয়ে ঝুলে গেল আম্বিয়া খাতুন মহিলা কলেজের এক প্রভাষকের সঙ্গে। বাড়িতে চিঠি লিখে পালিয়েও গিয়েছিল। কিন্তু ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ায় কমলাপুর স্টেশনে দুজন আটক হওয়ার ফলে একটি প্রেমের সমাধি রচিত হয়েছিল সেখানে।
নেয়ামত উল্লাহর কাছে তাঁর কন্যারত্নের কীর্তিময় অতীত জানার পর যে প্রশ্নটি প্রথমেই আমার মনে উদিত হলো, তা হচ্ছে, ‘আমি কী করতে পারি?’
‘পারো বাবা, তুমিই পারবে,’… প্রায় অতল জলের ঘূর্ণিস্রোতে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যেন আমার হাতটা ধরে কূলে উঠতে চাইলেন নেয়ামত সাহেব, ‘তুমি আমার মা-মরা মেয়েটাকে মানুষ করার দায়িত্ব নাও।’
আমি তো মানুষ গড়ার কারিগর নই, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র। পাস করে সুন্দর বহুতল ভবন, বাড়িঘর তৈরির স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু কোনো কথা শুনতেই রাজি নন নেয়ামত উল্লাহ। বললেন, ‘তোমার বাবা আমার বন্ধু। যখন সেই ছোট্ট ছিলে, তখন থেকে তোমাকে দেখছি। যেমন মেধাবী, তেমন ভালো চরিত্রের একটা ছেলে…কোনো দিন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাওনি…।’
কথাটা সত্যি। আমি ছাত্র ভালো। কিন্তু মেয়েদের দিকে না তাকানোর মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তার কিছু নেই। আমি একটু নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ…মেয়েদের দিকে তাকাতে ভয়ই পাই, এ নিয়ে আমার সহপাঠিনীরা কম ঠাট্টা করে না। এসব কথা নেয়ামত উল্লাহকে বলা যায় না। তিনি আমার হাত দুটো ধরেই আছেন, ‘সামনে মেয়েটার এইচএসসি পরীক্ষা, মেয়েটা গাধা, ওকে পড়ানোর দায়িত্বটা তুমি নাও, অন্য কোনো টিউটরকে ভরসা করতে পারছি না।’
আমার মা বললেন, ‘রাজি হয়ে যা বাবা, নেয়ামত ভাই আমাদের আপন মানুষ, এত করে বলছেন!’
অগত্যা আমি রাজি হলাম। প্রথম দিন ফারহানা আমাকে মিষ্টি গলায় ‘মামুন ভাই’ বলে সম্বোধন করল। প্রথম রাতেই বিড়াল মারার আয়োজন করলাম, গম্ভীর গলায় বললাম, ‘আমি তোমার শিক্ষক, মামুন ভাই না, আমাকে স্যার বলে ডাকবে।’
ফারহানা বলল, ‘আচ্ছা স্যার।’
দু-এক দিন পড়ানোর পর বুঝলাম, মোটেই গাধা না। লেখাপড়ায় ভালো। কিছুদিন যাওয়া-আসার পর যখন সম্পর্কটা অনেক সহজ হয়ে এসেছে, একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু মনে কোরো না, শুনলাম, তোমার নাকি অনেক ঘটনা…মানে এই প্রেমট্রেম…।’
ফারহানা হেসে ফেলল, ‘ঠিক শুনেছেন স্যার। আসলে দোষ আমার না, আমি দেখতে সুন্দর তো, সবাই আমার প্রেমে পড়ে যায়…।’
আমি তো মেয়েদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না, তবু কৌশলে লক্ষ করে দেখলাম, কথাটা ঠিক। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। ফরসা ডিম্বাকৃতির মুখ, গাঢ় কালো চোখ। হাসলে এক পাশে একটি গজদন্ত বেরিয়ে পড়ে, তাতে হাসিটা সুন্দর হয়ে ওঠে আরও।
ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘সবাই তোমার প্রেমে পড়লে তোমারও পড়তে হবে?’
‘সবার প্রেমে তো পড়িনি, তিনজনের…কেউ যদি বলে তোমাকে ছাড়া বাঁচব না, তখন খারাপ লাগে না? কী করব…।’
‘শোনো, এসব বাজে কথা, ছেলেরা এ রকম বলে, কেউ মরে না। তোমার প্রেমিকেরা কেউ মরেছে?’
‘না স্যার, কেউ মরেনি, একজন তো বিয়েই করে ফেলেছে’—বলে ফিক করে গজদন্ত দেখিয়ে হেসে ফেলল ফারহানা।
‘এরপর কেউ যদি প্রপোজ করে, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না বলে, তুমি এক মিনিট চোখ বন্ধ করে আগের ঘটনাগুলোর কথা মনে করবে, তারপর চোখ খুলে শান্ত গলায় বলবে, দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না। ঠিক আছে? বলতে পারবে?’
‘পারব স্যার।’
এর মধ্যে পরীক্ষা এসে গেল ফারহানার। আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করলাম ছাত্রীর জন্য। সব কটি পরীক্ষাই ভালো হয়েছে। শেষ পরীক্ষার পরের দিন আমার উপদেশগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে বিদায় নিলাম।
এদিকে আমারও ফাইনাল পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এসেছে। নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া দরকার। কিন্তু ইদানীং সন্ধ্যার সময় আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। উদ্দেশ্যহীন কিছুক্ষণ পথে পথে হেঁটে ঘরে ফিরে আসি। পড়তে বসে বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা লাগে, চোখ বন্ধ করলে একটি হাসিমাখা মুখ ভেসে ওঠে মনে, একটি গজদন্ত বেরিয়ে পড়া অপূর্ব সেই হাসি। কী হলো আমার!
এ অবস্থার মধ্যে একদিন মিষ্টি নিয়ে নেয়ামত উল্লাহ সাহেব হাজির। মেয়ে গোল্ডেন পেয়েছে। আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘ভালো ফল করেছে সেটা বড় কথা না, তুমি আমার মেয়ের স্বভাবটাই পাল্টে দিয়েছ, জানতাম তুমি পারবে…’ ইত্যাদি।
আমার একটু অভিমান হলো, রেজাল্টের খবরটা নিজে একবার ফোনে জানাতে পারত ফারহানা। রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি। সকালে নিজেই ফোন করলাম। ফারহানা বলল, ‘কেমন আছেন, স্যার?’
বললাম, ‘আছি, ভালো আছি। তুমি একবার দেখা করতে পারবে?’
‘বাসায় আসবেন?’
‘না, বাসায় না, তোমার কলেজের সামনে…।’
ফারহানা এল। আমাকে দেখে প্রায় চমকে উঠে বলল, ‘এই কদিনে এত রোগা হয়ে গেছেন স্যার!’
আমার আবেগের বাঁধ ভেঙে গেল। আম্বিয়া খাতুন মহিলা কলেজের গেটের পাশে যে শিমুলগাছটা, তার আড়ালে আমি ফারহানার হাত ধরে ফেললাম, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না ফারহানা…।’
ফারহানা চোখ বুজল, কী যেন ভাবল মনে মনে, তারপর চোখ খুলে শান্ত গলায় বলল, ‘দুঃখিত স্যার, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।’
 
+ Submit Feedback